• ২৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ছাতকে নারী এলএসডি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকা ঘু ষ বাণিজ্যের অ ভি যো গ

sylhetcrimereport
প্রকাশিত জুন ২৮, ২০২৫
ছাতকে নারী এলএসডি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকা ঘু ষ বাণিজ্যের অ ভি যো গ

সংগৃহিত

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় সরকারি খাদ্যগুদামে ধান সংগ্রহকে কেন্দ্র করে এলএসডির নারী কর্মকর্তা সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকার ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠেছে। সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ী ও মিল মালিকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুষ বিনিময়ে ধান কেনার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

এতে অসাধু ব্যবসায়ী এবং খাদ্যগুদামের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাভবান হলেও বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। এ অবস্থায় অভিযোগের বিষয়ে তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

একজন নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখে কৃষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং সরকারি অর্থ অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা।

ছাতক খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা যায়, ৯৪৫ মেট্রিক টন ধানকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে গত ২৪ মে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান সংগ্রহের কথা থাকলেও, গত ১৮ জুন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।

এদিকে স্থানীয় বাজারে প্রতি মণ (বড়) ধানের মূল্য ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকা হলেও, কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকার ১৪৪০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয় বাজার থেকে কম দামে ধান কিনে এবং ভুয়া কৃষক ভাড়া করে সরকারি গুদামে বিক্রি করছেন।

অভিযোগ উঠেছে, নারী এলএসডি কর্মকর্তা সুলতানা পারভীন নিজেই তাঁর বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বিভিন্ন মিল থেকে সরকারি বস্তায় ধান ভরে সরাসরি গুদামে বিক্রি করছেন। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালের সরকারি বস্তা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যা বাইরে আটক হলে পুরোনো বস্তা বলে চালানো হয়।

অভিযোগকারীদের দাবি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি টন ধানে ৪ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে, যা সুলতানা পারভীনের পকেটে যাচ্ছে। অন্যান্য বছর লটারির মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হলেও, এ বছর পকেট ভারী করার জন্য লটারি হয়নি।

একাধিক কৃষকের তথ্যানুসারে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৩০০ টন ধান গুদামে বিক্রি করেছেন। খোদ খাদ্যগুদামের নারী কর্মকর্তা সুলতানা পারভীন, পিএস ইয়াকুব, গুদাম কর্মচারী আবুল কাশেম এবং লেবার সর্দার আবদুল করিমের মাধ্যমে সর্বাধিক ধান বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিনি উপজেলার সাদারাই গ্রামের ছুরুক মিয়া ও আলমপুর (ভাওয়াল) গ্রামের আবু তাহেরসহ বিশ্বস্ত লোক দিয়ে ধান কিনে নিজের গুদামে বিক্রি করছেন। এছাড়াও বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সমছুদ্দিন, চেচানের ব্যবসায়ী আনোয়ার, জাউয়ার মিল ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা পিলিপ বাবু, বুড়াইরগাঁও-এর আনোয়ারা অটো রাইস মিলের জনৈক ব্যবসায়ীসহ আরও একাধিক ব্যবসায়ী এই অনিয়মে জড়িত বলে জানা গেছে।

এসব ব্যবসায়ী জেলার ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্নমানের ধান কিনে ঘুষের বিনিময়ে খাদ্যগুদামে বিক্রি করছেন। তারা সহজ-সরল কৃষকদের ভাড়া করে গুদামের স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে ব্যাংক থেকে ধান বিক্রির টাকা তুলছেন। কৃষি বাতায়ন তথ্যানুসারে, এই উপজেলায় ৮ হাজার ২৫ জন কৃষক থাকলেও, হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক ঘুষ দিয়ে ধান বিক্রি করলেও অধিকাংশই ব্যবসায়ী কৃষক ভাড়া করে গুদাম কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে তাদের নাম ব্যবহার করে ধান গুদামজাত করছেন। এই চক্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলেমিশে একাকার।

গণনা করে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে সংগৃহীত ৭০০ মেট্রিক টন ধানে ৪ হাজার টাকা করে ঘুষ নিলে ২৮ লাখ টাকা বাণিজ্য হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৯৪৫ মেট্রিক টন সংগ্রহের পর শুধু ঘুষ বাণিজ্য ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। নিজস্ব লোক দিয়ে ধান ক্রয় করে গুদামজাত করলে প্রতি মণ ধানে ৩০০ টাকা লাভ আসছে, যা থেকে কয়েক লাখ টাকা বাণিজ্য করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সব মিলিয়ে এ বছর প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করে কিভাবে এই নারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির খবর পেয়ে নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা এবং দোয়ারাবাজারের ফেরি চালকের ছেলে, তথাকথিত সাংবাদিক সাজ্জাদ মনির ওরফে ইয়াবা মনির ও দোয়ারাবাজার এলাকার সাংবাদিক আবু বক্কর খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা সুলতানা পারভীনের কাছে মাসিক ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত নারী কর্মকর্তার বক্তব্যে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ছাতক খাদ্যগুদাম (এলএসডি) কর্মকর্তা সুলতানা পারভীন চাঁদা দাবির বিষয়টি প্রচার না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কেনা এবং টন প্রতি ৪ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ২০১২ সালের কৃষি অফিস থেকে দেওয়া তালিকার ভিত্তিতে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, কিছু ব্যক্তি দলের পরিচয় দিয়ে ধান কেনার জন্য তাকে চাপ দিচ্ছেন এবং ব্যবসায়ীরা ধান বিক্রির জন্য আসলেও তাদের ধান কেনা হচ্ছে না। কৃষি কার্ড ও এনআইডি দেখে কৃষকদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ধান কিনে গুদামজাত করা হচ্ছে।

এব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিক হোসেন খান জানান, খাদ্যগুদামে প্রতি বছর কৃষকদের তালিকা দেওয়া হলেও তারা সাধারণত পাইকারদের (ব্যবসায়ী) কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে থাকেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম জানান, তারা কিভাবে ধান সংগ্রহ করছেন সে বিষয়ে তাকে অবগত করা হয়নি। তিনি খোঁজখবর নিয়ে বিধি মোতাবেক তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।