সিলেট নগরীর ৩৭ নং ওয়ার্ড আখালিয়ার বড়গুলে শতকোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি জবরদখল করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিক্রি করার খবর পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে দখলদাররা দেবোত্তর সম্পত্তি টিলা শ্রেনীর ভূমি কর্তন করিয়া বাসা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তারাপুর চা বাগানের ভিন্ন দাগের এই টিলা শ্রেনীর ভুমি একসময় সিলেটের শিল্পপতি রাগীব আলীর দখলে ছিল। রাগীব আলীর দখলে থাকাকালীন সময়ে তিনি এখানে একটি রাবার বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় দখলদাররা দেবোত্তর সম্পত্তিকে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি দাবী করে রাবার বাগান উজাড় করে দখলে নিয়ে বিক্রি করতে থাকেন বিভিন্ন লোকজনের কাছে। স্থানীয় ভূমিখেকোরা সম্পত্তির দখল ঠেকিয়ে রাখতে বাসাবাড়ির পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (রহ.) জামেয়া ইসলামিয়া রইছুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তারাপুর চা বাগানের সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে দখলদার সিলেটের আলোচিত শিল্পপতি রাগীব আলীর এরই মধ্যে সাজা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায়ে বড়গুল এলাকায় অবস্থিত পুয়াইল টিলার দেবোত্তর সম্পত্তির ভূমিও তারাপুর চা বাগানের সম্পত্তি বলে অভিমত দেন। কিন্তু ভিন্ন দাগ ও চা বাগান এলাকা থেকে দূরে হওয়ায় সেখানে ভিন্ন ভিন্ন মালিক ও দখলদারের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারাপুর চা বাগানের কাহিনীর সঙ্গে বড়গুলের পুয়াইল টিলার দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মসাতের মিল রয়েছে। শিল্পপতি রাগীব আলী ও সেবায়েত মিলে যেভাবে দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর করেছেন, পুয়াইল টিলার বেলায়ও ঘটেছে তেমনি। টিলার মালিকানা দাবি করে এখনও বিক্রি ও দখল অব্যাহত রেখেছেন দখলদাররা। স্থানীয়দের দখলে যাওয়ার আগে টিলাটি রাগীব আলীর দখলেই ছিল। তিনি সেখানে একটি রাবার বাগানও করেছিলেন। ১৫-১৬ বছর আগে রাবার বাগান উজাড় করে ধীরে ধীরে টিলা দখল করে নেওয়া হয়। তারাপুর চা বাগানের ৪২২ একর জায়গা একাই ভোগ করেছিলেন রাগীব আলী। আর বড়গুলের ওই টিলা স্থানীয় মইন উদ্দিন ও ওসমান মিয়ার নেতৃত্বে ভোগদখল করে আছেন শতাদিক লোকজন।
এসএ রেকর্ড অনুযায়ী, পুয়াইল টিলায় দুটি দাগে ৫২ একর ৩০ শতক ভূমি রয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ওই জায়গা থেকে ৩৩ একর ৫৩ শতক জায়গা অধিগ্রহণ করে। অবশিষ্ট ১৮ একর ৭৭ শতক জায়গা থেকে যায় পুয়াইল টিলায়, যার মালিক শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর পক্ষে তারাপুর চা বাগানের সেবায়েত। স্থানটির বর্তমান বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি। সিলেট নগরীর ৩৭ নং ওয়ার্ড কুমারগাঁও মৌজার ওই জায়গার জেএল নং ৮০, খতিয়ান নং ৪৬৬ ও দাগ নং ২০৫৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কেটে নেওয়া জায়গার দাগ নং ২৮০৬।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, ২০০৬ সালের দিকে টিলার রাবার বাগান উজাড় করে একাংশ দখল করেন বড়গুলের ওসমান মিয়া এবং আরেক অংশ মইন উদ্দিন। পরে ওসমান মিয়া এবং মইন উদ্দিন একাধিক ব্যক্তির কাছে ফারগ ও পাট্টামূলে সম্পত্তির কাগজপত্র দেখিয়ে বিক্রি ও দখল দেন। ওসমান মিয়া মারা যাওয়ার পর তার বিক্রি করা একাংশে বসবাস করছেন বর্তমান দখলদার ফকরুল, ছুরত আলী, মন্নান, সিদ্দেক, রাসেল। এবং টিলার পুর্ব অংশে দখল করে বসে আছেন মইন উদ্দিন ও তার লোকজন। জায়গাটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন বলে দাবী করেন মইন উদ্দিন। এর মধ্যে নগরীর আম্বরখানা বড়বাজারের বাসিন্দা হাফেজ রইছ উদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও এতিমখানা রয়েছে। রইস উদ্দিন এর দাবি তিনি মইন উদ্দিন এর কাছ থেকে জায়গা কিনেছেন।
মইন উদ্দিন আরও জানান, তার বাবা মিসকিন আলী জায়গা দেখাশোনা করতেন। সেবায়েতের কাছ থেকে পাট্টামূলে ১৯৩৪ সালে জায়গার মালিক হন তার বাবা। এ নিয়ে মামলা হলে ১৯৭৩ সালে আদালত তার পক্ষে রায় দেন। ২০১২ সালে মইন উদ্দিন আঁতাত করে রইছ উদ্দিনের কাছে প্রায় ৪ একর জায়গা বিক্রি করেন। ২০১৪ সালে রইছ উদ্দিন সেখানে গড়ে তোলেন মাদ্রাসা ও এতিমখানা।
গত বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেবোত্তর সম্পত্তি দখল টিলা কেটে ঘর-বাড়ী ও মাদ্রাসার নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সত্যতা পাওয়া যায়। বড়গুল এলাকার একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপ কালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান দেবোত্তর সম্পত্তি গ্রাস করতে দখলদাররা জাল কাগজপত্র তৈরি করেছেন। প্রথমে ওসমান মিয়া তার লোকজন নিয়ে এবং পরে মইন উদ্দিন গং টিলাটি দখল করে নিয়েছেন। রইছ উদ্দিন রহস্যময় মানুষ। টিলার ভেতর মাদ্রাসা করার কোনো যুক্তি নেই। মূলত দখল ঠেকিয়ে রাখতেই তাকে নিয়ে এসেছে ভূমিখেকোরা।
এ প্রসঙ্গে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ রইছ উদ্দিন এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান অনেক আগেই এই জায়গা বড়গুলের মইন উদ্দিন এর কাছ থেকে কিনেছেন। পরবর্তীতে এখানে একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। টিলা কাটার দায়ে এর আগেও পরিবেশ অধিদপ্তর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল। বর্তমানে তিনি নতুন করে আর টিলা কাটছেন না।
দেবোত্তর সম্পত্তি টিলা দখল এবং কাটা প্রসঙ্গে আখালিয়া ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন এর সাথে সরাসরি দেখা করে জানতে চাইলে তিনি জানা দেবোত্তর সম্পত্তি জবরদখল এবং টিলা কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কে অবহিত করা হয়েছে। যা ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃক নিবেন।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ না করায় বক্তব্য সংগ্রহ করা যায় নি।
সিলেট ক্রাইম রিপোর্ট/এস এ