• ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সিলেটে ক্রিস্টাল রোজে পার্টনারের নাটক মঞ্চস্থ 

sylhetcrimereport
প্রকাশিত মার্চ ২৬, ২০২৫
৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সিলেটে ক্রিস্টাল রোজে পার্টনারের নাটক মঞ্চস্থ 
সিকারি ডেস্ক:: ৮৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে ‘অপহরণ’ চেষ্টা নাটক মঞ্চস্থ করেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম। তার ব্যবসায়িক পার্টনারকে মব জাস্টিদের মাধ্যমে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেষ্টা করেন। নিজেই স্টিয়ারিং সীটে বসে পার্টনারের বিনিয়োগকৃত কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় লিপ্ত হন। এ জন্য বিএনপি নেতাদেরও নিয়ে টোপে ফেলার চেষ্টা করেন।
বিএনপি নেতাদেরও অনেকে গা ভাসিয়ে দেন। তবে ফাঁদে ফেলার অভিনব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। যদিও বিএনপি নেতারা আওয়ামী ঠিকাদার শফিকের জন্য হোটেলে জড়ো হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন কার ফোন পেয়ে কীভাবে জড়ো হলেন।
১৯ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে নগরীর ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই সড়কের হোটেল ক্রিস্টাল রোজে এই অপহরণ নাটক মঞ্চস্থ হয়। ঘটনার নেপথ্যোর কাহিনী জানতে অনুসন্ধান করা হলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-মধ্যনগর সড়কের ৮৬ কোটি ৬০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৮ টাকার কাজ সওজ থেকে পাশ করা হয়। মেসার্স বদরুল ইকবাল লিমিটেড এর নামে। লাইসেন্সের মালিকের ঠিকানা রাজধানী ঢাকার বনানী ব্লক-এ রোড ৪, বাড়ি ৩৩, ফ্ল্যাট-৬-বি। ওই লাইসেন্সে কাজ দেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আজাদ হোসেন। তার সঙ্গে লভংশে পার্টনার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাধাঘাট সওজের কাজে টেন্ডার দিতে আজাদ হোসেনকে আগ্রহী করেন। তার কথায় চেয়ারমান আজাদ সম্মত দিলে লাইসেন্স নিজে যোগাড় করবেন বলেন শফিক। তখন লভংশের অর্ধেক চেয়ে চুক্তি করে এবং তার সঙ্গে সওজের এডিশনাল চিফ, সাংবাদিকসহ আরো অনেকে আছেন বলে দাবি করেন। কাজ হওয়ার আগেই সাড়ে ৩ কোটি টাকা দিতে হয় আজাদ চেয়ারম্যানকে। ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে সাড়ে ৩ কোটি টাকার চেক দিয়ে চুক্তিনামা করেন শফিক।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বদরুল ইকবাল কর্তৃক চেয়ারম্যান আজাদের নামে অথরাইজড লেটারও দেওয়া হয়। কাজ চলাকালিন চলমান কাজের বিল আসে ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রথম বিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে বিলের চেক জমা দেন আজাদ। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠনের একাউন্টে ২ কোটি টাকা রেখে দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান আজাদ এ ব্যাপারে শফিককে জিজ্ঞেস করলে বলে পরে হিসাব করবো। পরে জোন অফিসে ১০ কোটি টাকার বিল প্রস্তুত হয়। ওই বিলের টাকা তুলে নিতে শফিক নিজে একটি অথারািজড লেটার জমা দেন। তখন বিল আটকে দেয় সওজ। অফিস থেকে বলে, আগে আজাদের নামে অথারাইজড ছিলো এখন এটা কেনো। বিষয়টি জানাজানি হলে আজাদ এবং শফিকের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেয়ারম্যান আজাদকে হোটেল ক্রিস্টাল রোজে ডেকে আনেল শফিক। সেখানে আগে থেকেই বিএনপির একাধিক নেতা, পুলিশ ও কয়েকজন সাংবাদিকও সংগ্রহ করে রাখা হয়।
ঘটনার বিষয়ে আজাদ হোসাইন বলেন, আমাকে ডিড দিতে খবর দিয়ে সিলেটে আনে শফিক। আসার পর উচ্চবাচ্য কথা বার্তা বলতে থাকে। তখন ৫ মিনিটের মধ্যে সব মানুষজন সাংবাদিক, পুলিশ চলে আসে। তাকে আওয়ামী লীগের লোক বলে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তিনি নিজে বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, সওজের কাজ করতে শফিকুল ইসলাম তার কাছে যায়। টাকা বিনিয়োগের কথা বলে। সে বলে এডিশনাল চিফের কাছের লোক। তার সাথে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা ঢাকার সাংবাদিকও রয়েছেন। মূলত এই সাংবাদিকের বলে বলিয়ান শফিক। সওজের কাজে বিনিয়োগে আগ্রহী হলে চুক্তি করি। লাভের অর্ধেক নেবেন ইতোমধ্যে কাজের প্রথম ধাপের বিল ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ছাড় পায়। এই টাকা থেকে ২ কোটি টাকা লাইসেন্সের অধিকারী বদরুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থেকে যায়। টাকা কদরুলের একাউন্টে জমা থাকার বিষয়ে শফিকের কাছে জানতে চাই। তখন আমি বলি, বিনিয়োগ করবো আমি, আর টাকা যাবে বদরুলের একাউন্টে। তার সঙ্গে চুক্তি হওয়া দরকার। এতেই আমাকে কাবু করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি আটে শফিক। বিএনপি নেতাদেরও সহযোগিতা নেন তিনি। এটা নিয়ে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেন বিএনপি নেতারা। সড়ক ভবন ঠিকাদার কেন্দ্রীক নেতাদের সংযুক্ত করে শফিক। এরমধ্যে ৩ সাংবাদিককেও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়।
ঘটনার সময় হোটেল ক্রিস্টাল রোজে থাকা বিএনপি নেতা হিসাম চৌধুরী বলেন, আমি ঘটনার দিন সকাল ১১টায় এখনে যাই। শফিক তাকে ঝামেলা হওয়ার কথা বলে সেখানে নেয়। আধাঘন্টা থেকে চলে আসি। কেননা, পরে জুনিয়ররা চলে আসে। মূলত। ‘তাদের দুই পার্টনারের ডিড নিয়ে ঝামেলা বুঝতে পারি। মিশু (জিএম) দেখে দিবেন বলেছেন।
মহানগর বিএনপির সহ সভাপতি সাদিকুর রহমান সাদিক বলেন, ওয়ার্ডের সভাপতি হিসেবে হোটেলের মালিক আমাকে খবর দিয়ে সেখানে নেন। যাওয়ার পর দেখি হট্টগোল। শফিক ও তার পার্টনারের মধ্যে ঝামেলা হয়। তখন পুলিশ আসে। বিষয়টি সুবিধাজনক নয় বুঝতে পেরে চলে আসি।
শফিকের পক্ষ হয়ে বিএনপির আরেক নেতা কামরুল হাসান শাহিনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনি সরাসরি শফিকের পক্ষপাতিত্ব করেন। যদিও তিনি সেখানে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে ঘটনাস্থলে তাঁর উপস্থিতির ভিডিও সিলেটের একটি দৈনিক পত্রিকা অফসে সংরক্ষিত আছে।
খবর পেয়ে ওই দিন ঘটনাস্থলে যাওয়া মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, তিনি শাবিপ্রবিতে ছিলেন। এসময় কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল তাকে ফোন দিয়ে ক্রিস্টাল রোজ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান। এর ১৫ মিনিট পর আবার ফোন দেন। তিনি তখন সাপ্লাইয়ের প্রবাস ফেরত বিএনপি নেতা সমসুকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে পাঠান। পরে তিনি ঘটনাস্থলে আসলে সাংবাদিক মুহিত ভেতরে ঢুকতে বারণ করেন। এতে হোটেলে প্রবেশ না করেই ফিরে আসি।
এ বিষয়ে ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারীর কারণে বিচ্ছিন্ন লোকের সাথে পরিচয়। এই সুবাদে চেয়ারম্যান আজাদ হোসেনের সাথে পরিচয় হয়। আমরা উভয় মিলে একটি কাজ গেয়েছি। ওই বিলের টাকা চেয়ারম্যান আজাদের একাউন্টে ঢুকে। কাজটা মূলত কোম্পানি আমাকেই দিয়েছে। কাজ শুরুর দিকে কোম্পানির চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ কাজের টাকাটা আমার একাউন্টে আসার কথা এবং এখান থেকে আমরা পার্টনার দুইজন সমন্বয় করে টাকা নেওয়ার কথা। ওই সময় প্রথম বিলের টাকার জন্য চেয়ারম্যান আজাদ আমাকে বলেন এই টাকাটা তার একাউন্টে জমা হলে পরবর্তীতে ব্যাংক থেকে লোন নেয়া যাবে এবং অন্য বড় সাইট রাখা যাবে। তখন আমি সরল বিশ্বাসে প্রথম বিলের ১০ লাখ টাকা আজাদের একাউন্টে দিয়ে দেই। এই টাকা নিয়েই আজাদের সাথে বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে ১৯ মার্চ হোটেল ক্রিস্টাল রোজে ডাকে নিয়ে বৈঠকে বসি। এতে আজাদ মারমুখি হয়ে উঠে। বিষয়াট তাৎক্ষনিক বিএনপি নেতাসহ আমাদের ঘনিষ্টজনদের জানাই। খবর পেয়ে তারা আসেন। তবে আজাদকে ক্রিস্টাল রোজে অপহরণ নাটকের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
ওই ঘটনার পর শফিকুল ইসলাম বাদি হয়ে মারপিট করে জখম ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনায় ২০ মার্চ কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৫ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৩/৪ জনকে অভিযুক্ত করেন। এজাহার নামীয় আসামিরা হলেন-সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আজাদ হোসেন (৫১), একই উপজেলার আনেয়ার পুত্রের ঝন্টু কুমার দাসের ছেলে জেনসন দাস (২৬), উপজেলার বাদাঘাট বাজার এলাকার রবি দাসের ছেলে নিশু দাস (৫০), পারভেজ ও জয়দেব পাখী।
তথ্য চিত্র: দৈনিক শ্যামল সিলেট ২৬/০৩