
পুলিশ বিজিবির অভিযান, গ্রেপ্তার কড়াকড়িতেও সিলেট সীমান্তে চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না। পটপরিবর্তনের পর আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। সক্রিয় এই সিন্ডিকেট পুলিশ-বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল বদল করেছে। সেইসাথে পাল্টেছে রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড। আগে চোরাচালানের সাথে আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর বিএনপির অঙ্গ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা চোরাকারবারের সাথে জড়াচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, পুলিশ-বিজিবির অভিযানে চোরাই পণ্য জব্দ হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা। কার মাধ্যমে এসব পণ্য দেশে আসছে, তা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তারা এসবের বাহক। ফলে বিজিবির লোক দেখানো অভিযান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সচেতন নাগরিকেরা।
যদিও পুলিশ ও বিজিবি জানিয়েছে আগের চেয়ে সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই চোরাচালান পণ্য জব্দ হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রতি রাতে ভারত থেকে গরু, মহিষ, চিনি, মাদকদ্রব্য, কাপড়, কসমেটিকস, বিস্কুট ও ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানিরা দেদারসে আমদানি করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে ইলিশ মাছ, শিং মাছ, রসুন, সুপারি, ছোলাবুট, শুকনো সুপারি, পটের দুধ, মটরশুটি ইত্যাদি পণ্য ভারতে পাচার হচ্ছে। চোরাচালানের পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে সীমান্তে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে।
সূত্র জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকাগুলো এখন চোরাচালানিদের হটস্পট হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে চোরাচালানিরা ট্রাকে ও পিকআপে করে পণ্য আনা-নেওয়া করছে। পুলিশ ও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল পাল্টেছে কারবারিরা। চোরাচালান পণ্যবাহী গাড়িতে পাথর ও বালু দিয়ে আলাদা আবরণ তৈরি করছে। দেখে বুঝার উপায় নেই; পাথর-বালুবাহী গাড়ি নকি চোরাচালানের পণ্যবাহী গাড়ি। সম্প্রতি বিজিবির কয়েকটি অভিযানে কৌশল বদলের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সচেতন নাগরিকেরা বলছেন চোরাচালান রোধে বিজিবির আরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্টের আগে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। যুবদল নেতা সুমন আহমদ আম্বরখানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নগরের শাহী ঈদগাহ এলাকায় ছাত্রদল নেতা রণি ও বড়বাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন বাবু।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, বিদায়ী বছরে সিলেট সীমান্তে ২৫ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার ৭৩৯ টাকার চোরাই মালামাল জব্দ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় নগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় ১৭৬টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬৯ জনকে।
অন্যদিকে বিজিবি সূত্র জানায়, গত এক বছরে সিলেটর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫৫ কোটি টাকার অবৈধ মালামাল জব্দ করেছে সিলেট ব্যাটেলিয়ন ৪৮ বিজিবি। এছাড়াও গত ছয় মাসে সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশি-বিদেশি ৪১ জন নাগরিককে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে ১১৫ কোটি টাকার চোরাচালান পণ্য জব্দ করা হয়েছে।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানার, ৫ আগস্টের পর চোরাচালান আরও বেড়েছে। চোরাচালানের হটস্পট হয়ে উঠেছে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত। প্রতিদিন আসছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। এছাড়া বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য আসছে বলে সূত্র জানিয়েছে। চোরাচালানের সঙ্গে আগে স্থানীয় প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা জড়িত ছিলেন। তবে পটপরিবর্তন হওয়ায় এখন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এসবে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে এসব অপকর্মের সাথে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জড়িত এমন অভিযোগ অসত্য বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, একটি সুযোগসন্ধানী চক্র বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করছে। তারা নিজেরা অপকর্ম করছে, আর দায় চাপাচ্ছে বিএনপির উপর। তবুও যদি আমাদের দলের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বিজিবির পাশাপাশি সীমান্তে পুলিশের নজরদারিও আরওবাড়াতে হবে। না হলে সীমান্তে নিরাপত্তার বড় ঝুঁকি থেকে যাবে। প্রশাসনের ঢিলেমির সুযোগে নাশকতাকারিরা বিস্ফোরক ও অস্ত্র নিয়ে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান বন্ধে পুলিশ নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সন্দেভাজন যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। চোরাচালান রোধে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।
সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। টহল আরও জোরদার করা হয়েছে। বিজিবির এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এস. এ…