
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, দখল বেড়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে দিবালোকে খুনোখুনি ঘটছে। এ অবস্থায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নগরের বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন গ্রæপ গড়ে উঠেছে। সক্রিয় হয়েছে অপরাধীরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির ঘটনা ঘটছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে জানুয়ারিতেই সিলেট নগরীসহ পুরো বিভাগ জুড়ে ২৫টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সিলেট নগরীর সাগরদিঘিরপাড় এলাকায় সরকারি জায়গা দখল নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ, গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসময় বেশ কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে পুলিশসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বেশ কয়েক বছর ধরে এসটিএস গ্রæপ নামে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট সাগরদিঘীরপাড়ের মৎস্য ভবনের পার্শ্ববর্তী সরকারি জায়গা দখল করে রেখেছিলো। দখলদাররা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো। তবে, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর সেই জায়গা দখলে নিয়ে ‘ড্রিম সিটি’ নাম দিয়ে ভবন নির্মাণ শুরু করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জামাল আহমদ খান ও লল্লিক চৌধুরীর। এ নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে ওই স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার অনুসারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নেয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে অপহরণের পরে সেই স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া একই সময়ে এ স্থানেই গণধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। এ ঘটনায় পরে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এদিকে পুলিশের দাবি, অপরাধ দমনে তারা সক্রিয় হয়ে কাজ করছেন। নিয়মিত টহল অব্যাহত রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশ একটি বিশেষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অনেক দুর্র্ধষ অপরাধী কারাগার থেকে বেরিয়েছে। তারা অপরাধের নতুন নকশা করছে। নিরাপত্তা ঘাটতির সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।’ তাঁদের মতে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধীরগতিতে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা অপরাধের প্রতিবাদ ও ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানোর আহŸান জানান।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- এ বছরের প্রথম মাসেই (২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত) সিলেট বিভাগে খুন, ধর্ষণ, হত্যা, মারামারি, চুরি, ছিনতাই, আত্মহত্যা ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০টিরও বেশি। যদিও সংশ্লিষ্টদের দাবি, সংবাদমাধ্যমে অপ্রকাশিত ঘটনাগুলো গণনা করলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ আগের মতো জেগে ওঠেনি। এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। কিছু এলাকায় নতুন সন্ত্রাস গ্রæপ গড়ে উঠেছে।
এর আগে গত বুধবার দিবাগত রাতে সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের দাড়াখাই নামক স্থানে গাছ ফেলে যানবাহন আটকে লুটপাট করেছে একদল ডাকাত। এ সময় ডাকাতের হামলায় বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। এসময় ডাকাতরা যাত্রীদের বেশকিছু মালামাল নিয়ে যায়। একইদিন হবিগঞ্জের মাধবপুরে ঘনশ্যামপুর গ্রামে মোবাইলে কথা বলায় নিজের মেয়েকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন এক বাবা। মাধবপুরের কাসিমনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুর মোহাম্মদ জানান, মঈন উদ্দিনের মেয়ে রানু মোবাইলে অতিরিক্ত কথা বলতো। ফোনে কথা বলতে নিষেধ করে আসছিলেন মঈন উদ্দিন। ঘটনার দিন দুপুরে মেয়েকে ফোনে কথা বলতে দেখে শাসন করেন। এক পর্যায়ে রানু রেগে গিয়ে বাবার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়। এসময় রাগান্বিত হয়ে ধারালো দা দিয়ে রানুর ঘাড়ে কোপ দেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় রানু। একইদিন হবিগঞ্জের সদর উপজেলার কালনী গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর লোকজনের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও ১৫ জন। নিহত কাজী দিপু (৪০) ওই গ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে।
গত ১৯ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের বড়লেখার বাড্ডা বাজারে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে নোমান আহমদ (৩৫) নামে এক যুবদল নেতাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত নোমান উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের রাঙ্গিনগর গ্রামের লেচু মিয়ার ছেলে। ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে শিমুলবাঁক ইউনিয়নের উকারগাঁও গ্রামের বোরো জমি থেকে মনির হোসেন (৩০) নামে এক যুবকের নাক-কান কাটা রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শান্তিগঞ্জ থানার ওসি মো. আকরাম আলী বলেন, এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহতের স্ত্রীসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। রহস্য উদঘাটনে কাজ চলছে।
গত ২১ জানুয়ারি দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বউ বাজারে টুকেরগাও ও নয়াগাঙের পাড় গ্রামের মানুষের মধ্যে মাছ বিক্রিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
এদিকে সিলেট মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করেছে সিলেট মহানগর পুলিশ। চুরি, ছিনতাই, চোরাচালান, আবাসিক হোটেল রেইড, মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৩৪ জন।
সিলেট মহানগর পুলিশ জানায়, গত ২১ জানুয়ারি মহানগরীর মিরাবাজার ও পাঠানটুলা এলাকায় পৃথক অভিযানে যাত্রীবেশে সিএনজি অটোরিকশায় ছিনতাই চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। আটক করা হয় দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। একইদিন সোবহানীঘাট ও শাহজালার উপশহরে পৃথক অভিযানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চোর চক্রের ৩ জনকে গ্রেফতার করে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ।
এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তায় প্রতিটি ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেলের মাধ্যমে মোবাইল টিমও কাজ করছে। সড়ক, মহাসড়কে চেকপোস্টে সর্তকর্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া অপরাধ-প্রবণ এলাকায় এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হচ্ছে।’
এস.এ…