• ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চোরাচালানের দ্ব ন্দে সিলেট : সী মা ন্তে বেড়েছে হ ত্যা

Desk
প্রকাশিত জানুয়ারি ৭, ২০২৫
চোরাচালানের দ্ব ন্দে সিলেট : সী মা ন্তে বেড়েছে হ ত্যা

প্রতীকী ছবি

সিলেটে সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সীমান্তের ওপারে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ভারতীয় খাসিয়ারা। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা। দুই পারের চোরাকারবারিদের লোভের আগুনে পুড়ছে সীমান্ত এলাকার হতদ্ররিদ্র মানুষ।

সীমান্ত এলাকার হতদরিদ্রদের লোভ দেখিয়ে চোরাই পণ্য আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করছে চক্রটি। মূলত এসব চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের দ্ব›েদ্ব সীমান্তহত্যা বেড়েছে। সেইসাথে বেড়েছে অনুপ্রবেশ। এ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় উদ্বেগ-শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকাগুলো এখন চোরাচালানিদের হটস্পট হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে চোরাচালানিরা মাদক, চিনি, কাপড়, কসমেটিকস পণ্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করছে। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল বদলেছে চোরাকারবারিরা। সচেতন নাগরিকেরা বলছেন চোরাচালান রোধে সীমান্তে বিজিবির টহল আরো জোরদার করতে হবে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় খাসিয়াদেরকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার দরকার।

এদিকে পুলিশ বিজিবির অভিযান, গ্রেপ্তার কড়াকড়িতেও চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না। এসব অভিযানে চোরাই পণ্য জব্দ হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে মুল হোতারা। যারা ধরা পড়ছে এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তারা এসবের বাহক মাত্র। বিজিবির লোক দেখানো অভিযান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সচেতন নাগরিকেরা। সূত্র জানায়, চোরাচালানের পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে সীমান্তে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। তবে পুলিশ ও বিজিবি জানিয়েছে আগের চেয়ে সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে।

সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত। প্রতিদিন আসছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। এ ছাড়া বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য আসছে বলে সূত্র জানিয়েছে। চোরাচালানের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিজিবির দাবি, চোরাকারবারিরা অন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে বাড়ছে হত্যা।

এক বছরে সীমান্তে ৭ বাংলাদেশিকে হত্যা: খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেছে, গত এক বছরে সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়াদের হাতে ৭ বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর দমদমিয়া এলাকার সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে সবুজ মিয়া (২২) নামের এক বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। তিনি গোয়াইনঘাটের ভিতরগুল গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে। এর একদিন আগে গত ২৬ ডিসেম্বর মিনাটিলা সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে মো. মারুফ মিয়া (১৬) নামের এক কিশোরকে হত্যা করে ভারতীয় খাসিয়ারা। তিনি জৈন্তাপুর উপজেলার ঝিংগাবাড়ি গ্রামের শাহাবুদ্দিনের রছলে। তারও আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর খাসিয়াদের গুলিতে মারা যান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ গ্রামের আশরাফ উদ্দিন। একই বছরের ১৪ জুলাই ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে খাসিয়াদের গুলিতে মারা যান দয়ারবাজারের কাউছার আহমেদ। একইদিনে মারা যান কোম্পানীগঞ্জের আলী হোসেন। ২৪ অক্টোবর খাসিয়াদের হাতে তাহিরপুর উপজেলার অজ্ঞাত এক যুবকের মৃত্যু ঘটে। একই বছরের ৬ নভেম্বর মারা যান জৈন্তাপুরের জমির উদ্দিন। তারও আগে খাসিয়াদের হাতে প্রাণ হারান কানাইঘাটের মাসুম আহম্মেদ। তারা সবাই খাসিয়াদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে বিজিবি নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি চোরাচালান পণ্য আসছে এই দুই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ভারতীয় চিনি, গরু, কসমেটিকস ও ওষুধ ভারত থেকে দেশে আনা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ থেকে পাচার রসুন ও দেশীয় ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ। সূত্র আরও জানায়, ভারতীয় খাসিয়াদের সুপারিবাগান ও জঙ্গলের ভিতর হয়ে চোরাচালান পণ্য নিয়ে আসে বাংলাদেশী নাগরিকরা। এক বস্তা মালামাল ভারত থেকে নিয়ে এলে তারা পায় ৫০০ টাকা। খাসিয়া ও বাংলাদেশী নাগরিকরা মিলেমিশে মালামাল আনা-নেওয়া করছে। এতে করে চোরাচালানের টাকার ভাগ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিয়েছে। যেকারণে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে।

সীমান্তে অনুপ্রবেশ বেড়েছে: সিলেটে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি দুই ভারতীয় নাগরিককে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি জানায়, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার সীমান্তে লাফার্জ বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শ্যামারগাঁও নামক স্থান থেকে তাদের আটক করা হয়। তারা হলো- শিলংয়ের ইস্ট খাসিয়া হিল জেলার সাইগ্রাম থানার কালাটেক গ্রামের তুফান বিশ্বাসের ছেলে নান্টু বিশ্বাস (২২) ও একই গ্রামের রাজেন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সুবোধ বিশ্বাস (৬৫)। তারও আগে গত ২৯ ডিসেম্বর অনুপ্রবেশের অভিযোগে ডাব্বর লাং (২৬) নামে এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে বিজিবি। ডাব্বর লাং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইস্ট খাসিয়া হিল জেলার পানিয়াসাল থানার লাপালং গ্রামের জুবেং সুটিংয়ের ছেলে। এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতে বিএসএফের হাতে ১৩ বাংলাদেশী নাগরিক আটক হন। আটককৃতদের মধ্যে ১০ জনের বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। বাকি ৩ জন গোয়াইনঘাট উপজেলার বাসিন্দা। বিএসএফ জানিয়েছে ২৩ ডিসেম্বর ভোররাত ৪টার দিকে বাংলাদেশের তামাবিল এলাকার বিপরীতে ভারতের ডাউকি এলাকার আনুমানিক ৫০০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে ১৩ জন বাংলাদেশী নাগরিককে অনুপ্রবেশ এবং চোরাচালানের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের ডাউকি থানায় হস্তান্তর করা হয়।

এক বছরে ১৫৫ কোটি টাকার পণ্য জব্দ: গত এক বছরে সিলেটর বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫৫ কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ করেছে সিলেট ব্যাটেলিয়ন ৪৮ বিজিবি। এছাড়াও গত ছয় মাসে সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশি-বিদেশি ৪১ জন নাগরিককে আটক করা হয়েছে। জব্দকৃত এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে নেশা জাতীয় ট্যাবলেট, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, গাঁজা, বিদেশী শাড়ি, কসমেটিক্স, চিনি, গরুসহ দেশ থেকে পাচার হওয়া রসুনের চালান।

বিজিবি সূত্র জানায়, জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত এক বছরে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবির অভিযানে ১৫৫ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ১১৫ কোটি টাকা মূল্যের চোরাচালান পণ্য জব্দ করা হয়েছে।

সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান বলেন, নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব নিয়ে একে অন্যের প্রতি চড়াও হচ্ছে চোরাকারবারিরা। চোরাকারবারের টাকা নিয়ে ভারতীয় খাসিয়াদের সাথে তাদের দ্বন্ধ হচ্ছে। আর এসবের বলি হচ্ছে পণ্য আনা-নেওয়ার সাথে জড়িত হতদরিদ্র লোকজন।

তিনি আরও বলেন, সীমান্ত দিয়ে দেশে কোনো অবৈধ পণ্য, মাদক কিংবা বিদেশী অস্ত্র যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একইসাথে সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। চোরাকারবারিদের দমন করতে বিজিবি বদ্ধপরিকর।

এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, খাসিয়াদের কৌশলে কেউ কাজে লাগিয়ে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার দরকার। সীমান্তে হত্যা বন্ধে ভারত-বাংলাদেশ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আন্তসম্পর্কে ছেদ পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

এস.এ…