• ১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সিলেটে জুলাই অ ভ্যু ত্থা নে এখনও হ তা হ তে র সংখ্যা নিয়ে ধু ম্র জা ল

Desk
প্রকাশিত জানুয়ারি ২০, ২০২৫
সিলেটে জুলাই অ ভ্যু ত্থা নে এখনও হ তা হ তে র সংখ্যা নিয়ে  ধু ম্র জা ল

প্রতীকী ছবি

আগামী ৩১ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ এবং আহতদের নাম তালিকাভুক্তির সময়সীমা। অথচ এখনও সিলেটের শহীদ পরিবারগুলোর অনেকেই স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আহতদের সুচিকিৎসার কথা বলা হলেও পা কেটে ফেলার উপক্রম হয়েছে গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী কামরানসহ অনেকের। রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক কোনো সূত্রই এসবের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারছে না। আর অসহায় পরিবারগুলোও তথ্য প্রযুক্তির বিভ্রান্তির কাছে অসহায় হয়ে আর্তনাদ জানাচ্ছে সবার কাছে। ফলে কোনোভাবেই আশান্বিত হতে পারছে না স্বজন হারানো এসব পরিবার, কিংবা জীবনের তরে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যাওয়া মুখগুলো।

গত জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়, আন্দোলনে নিহত-আহত পরিবারগুলো দায়িত্ব তারা নেবেন। এরপর জুলাই ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করে। এ পর্যায়ে সারাদেশের শহীদদের পরিবারগুলোর মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা করে প্রদান করে। আহতদের মধ্যেও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়। ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রথম ধাপের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে ৮২৬ শহীদের নাম। এর মধ্যে এ তালিকায় সিলেটের রয়েছেন ১২ জন। যদিও সিলেটের ১৪ জনের পরিবার সহায়তা পেয়েছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গত মাসে ১৪ জন শহীদের পরিবারকে অর্থ প্রদান করে জুলাই ফাউন্ডেশন। সে সময় জানানো হয় তারা ২০ জনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অন্যদেরকে তথ্যগত অসংগতির কারণে দিতে পারেননি। পরবর্তীতে দেবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটে জেলায় বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং সমর্থিত অসমর্থিত সূত্র যেসব ছাত্র-যুবকের নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে এর মধ্যে রয়েছেন, শাবি ছাত্র, দিনাজপুরের সদর উপজেলার পাহাড়পুরের রুদ্র সেন- সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার ফতেহপুর গ্রামের মরহুম মাস্টার আব্দুর রহীমের কনিষ্ট পুত্র সাংবাদিক এ টি এম তুরাব, গোলাপগঞ্জ উপজেলার দড়া গ্রামের যুবদল নেতা জিল্লুর রহমান দিলু, দত্তরাইল গ্রামের মিনহাজ আহমদ, নিশ্চিন্ত গ্রামের নাজমুল ইসলাম, একই গ্রামের সানি আহমদ, ধারাবহর গ্রামের তাজ উদ্দিন, রায়গড় গ্রামের হাসান আহমদ, একই উপজেলার কানিশাইল গ্রামের হাফিজ কামরুল ইসলাম পাবেল, বিয়ানীবাজার উপজেলার নয়াগ্রামের রায়হান গাজী, যার মুলবাড়ি ব্রাম্মনবাড়িয়া, একই থানার পৌরশহরের বাসিন্দা ময়নুল ইসলাম, তিনি বিয়ানীবাজারের ভাসমান ব্যবসায়ী ছিলেন। বিয়ানীবাজার থানার কটুখালির পার গ্রামের তারেক আহমদ (মুল বাড়ি: ব্রাম্মনবাড়িয়া), সিলেট নগরের ঝালোপাড়ার আখড়াগলির নিখিল করের পুত্র পংকজ কর। গোয়াইনঘাট থানার পান্থুমাই গ্রামের রাহিম আহমদ সিয়াম, ইসলামাবাদ গ্রামের নাহেদুল ইসলাম, একই উপজেলার ফেনাইকোনা গ্রামের সুমন মিয়া। এছাড়া ঢাকা ও হবিগঞ্জে সিলেটের আরো দুজন প্রাণ হরান। এরা হলেন- সিলেট সদর উপজেলার ইনাতাবাদ গ্রামের ওয়াসিম আহমদ এবং গৌরিপুর গ্রামের মোস্তাক আহমদ।

এদের মধ্যে সিলেট জেলার চার জনের নাম ওঠেনি শহীদের তালিকায়। সহায়তা ও নাম তালিকাভুক্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছে তাদের পরিবার। কিন্তু এ যাবদ কোনো ফল পাননি। কেউ কোনো খোঁজও নেয় না তাদের। এতে হতাশ তাদের পরিবার। শহীদের তালিকায় না ওঠা নামগুলোর মধ্যে রয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ইসলামাবাদের উছমান আলী ও শফিকুন নেছার ছেলে নাহেদুল ইসলাম, একই উপজেলার পান্তুমাই গ্রামের ফখর উদ্দিন ও শিরিনা বেগম দম্পতির ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র স্কুলছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম, উপজেলার সদর ইউনিয়নের ফেনাইকোনা গ্রামের আবদুন নূর বিলালের ছেলে সুমন মিয়া এবং সিলেট নগরের ঝালোপাড়ার আখড়াগলির বাসিন্দা নিখির করের ছেলে পংকজ কর। গোয়াইনঘাটের তিনজন ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে বেরিয়ে বিজিবি’র গুলিতে প্রাণ হারান। আর ৬ আগস্ট পংকজ করের লাশ উদ্ধার হয় সিলেটের কোতোয়ালী থানার ভেতরে ধ্বংসস্তুপের পাশ থেকে। তিনি আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন নাকি বিজয় মিছিলে বেরিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে নাহেদুল ইসলাম। স্থানীয় এক ইউপি সদস্য তাঁর পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো সহায়তা পায়নি দরিদ্র পরিবারটি।

তিনি জানান, নাহেদুলের মৃত্যুর পর সহায়তা ও নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে আবেদন করেছিলেন অসুস্থ বাবা উছমান আলী। কিন্তু এখনও কিছু জানানো হয়নি।

উপজেলার পান্তুমাই গ্রামের ফখর উদ্দিনের ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম আহমদ রাহিম। শিরিনা জানান, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বিজয় মিছিল যাচ্ছিল। এতে রাহিমও যোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে, সে বিজিবির গুলিতে মারা গেছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে ৭ অক্টোবর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান করে। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ শিশুদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকার চেক ও ক্রেস্ট দেন উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশীদ। এর বাইরে কোনো সহায়তা মেলেনি।

রাহিমের চাচা আলীম উদ্দিন বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষে রাহিম গুলিবিদ্ধ হয়। নাহেদুল ও সুমনের লাশ ঘটনাস্থলেই পাওয়া যায়। তবে রাহিমের লাশ ৮ আগস্ট পার্শ্ববর্তী পিয়াইন নদীতে ভেসে ওঠে। তার নাম শহীদের তালিকায় তোলার জন্য জেলা প্রশাসক, ইউএনও, শিশু ও মহিলাবিষয়ক উপদেষ্টার দপ্তরে আবেদন করেছি। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছি। তিনি বলেছেন, বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেননি।

গোয়াইনঘাট সদর ইউনিয়নের ফেনাইকোনা গ্রামের আবদুন নূর বিলালের ছেলে সুমন মিয়া সো’মিলের ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। বিলাল জানান, সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের সামনে বিজিবি সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারান সুমন। ছেলের মৃত্যুর পর প্রথমে ইউএনও, পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসক, মন্ত্রণালয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের কাছে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তারা আজও কোনো ব্যবস্থা নেননি।

সুমন নিহতের ঘটনায় ২৭ আগস্ট আদালতে মামলা করেন বিলাল। মামলায় সিলেট-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইমরান আহমদসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়া ৫ আগস্ট সোনারহাট ক্যাম্পে কর্মরত সব বিজিবি সদস্যসহ অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে ক্যাম্পে লুটের অভিযোগে বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা হয়। ২০ আগস্ট যৌথ স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রে বিজিবি সদস্যের গুলিতে সুমনের নিহতের বিষয়টি উল্লেখ করেন সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী সুমন ও ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মতিউর রহমান ৩০ সেপ্টেম্বর ইউএনওর কাছে একটি প্রতিবেদন দেন। তাতে রাহিম, নাহেদুল ও সুমন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

শহীদের তালিকায় তিনজনের নাম ওঠাতে গড়িমসির কারণ জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, তালিকা করার সময় তাদের বিষয়ে আপত্তি আসে। তারপরও পরিবারের পক্ষ থেকে তালিকাভুক্তির আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এখনও যাচাই-বাছাই চলছে।

গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ বলেন, তিনজন নিহতের বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে। আমাদের কাছে যখন মামলাটি ছিল, তখন তদন্ত কর্মকর্তা লাশ উত্তোলনের আবেদন করেছিলেন। লাশ তোলার নির্দেশও দিয়েছিলেন আদালত। মামলাটি সিআইডিতে চলে যাওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। তবে আদালতের আদেশ বহাল আছে।

স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল কোতোয়ালি মডেল থানা এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এ সময় মাদ্রাসাছাত্র হাফিজ কামরুল ইসলাম পাবেল গুলিতে প্রাণ হারান। বিক্ষুব্ধ জনতা চড়াও হয় পুলিশের ওপর। এ সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে অনেকের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন পঙ্কজ। ৬ আগস্ট সকালে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা হয়েছে।

পংকজের পিতা নিখিল চন্দ্র বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মোট ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা পেয়েছি। কিন্তু পঙ্কজের নাম শহীদের তালিকায় ওঠেনি। নাম ওঠাতে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও জানানো হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি নেই। কেউ খোঁজও নেয় না।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট জেলার মুখ্য সংগঠক নাইম শেহজাদ বলেন, আমাদের যাচাই-বাছাই কমিটি এখনও কাজ করছে। গোয়াইনঘাটে নিহত তিনজন ও পঙ্কজের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে তালিকা করা হয়। গোয়াইনঘাটে নিহত তিনজনের তালিকভুক্তির জন্য পরিবার থেকে আবেদন করা হয়েছিল। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে বলেছি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, কারা নিহত ও আহত হয়েছেন, সেটি নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। তারা যাচাই-বাছাই করে তালিকা দেয়। তালিকা থেকে কেউ বাদ পড়লে আবেদন করার সুযোগ আছে।

এস.এ…