• ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুরে হ্যান্ড টিউবওয়েল স্থাপন প্রকল্পের ৩৪ কোটি টাকা জলে

Desk
প্রকাশিত মার্চ ৩, ২০২৫
শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুরে হ্যান্ড টিউবওয়েল স্থাপন প্রকল্পের ৩৪ কোটি টাকা জলে

ছবি : সংগৃহীত

সুনামগঞ্জ-৩ আসনের দুই উপজেলা জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জে স্থাপনের দুই বছরের মাথায় পানি উঠছে না প্রায় পাঁচ হাজার সরকারি টিউবওয়েলে। সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এসব টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল।
টিউবওয়েলগুলোতে পানি না ওঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের হাজারো পরিবার। তবে এই প্রকল্প শান্তিগঞ্জ ও জগন্নাথপুরের জন্য উপযুক্ত নয় জানালেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্যের সুনামগঞ্জের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী। অপরিকল্পিতভাবে সরকারের টাকা অপচয় করা হয়েছে দাবি করলেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মন্ত্রীর সংসদীয় আসন শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুর উপজেলার পল্লী এলাকার মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের জন্য শত কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বাস্তবায়ন সংস্থা হিসেবে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন তৎকালীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী। এই প্রকল্পের আওতায় শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামে সাড়ে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ হাজার ৩০০ হ্যান্ড টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়। আরও ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার ৯৫০টি টিনশেড ল্যাট্রিন তৈরি করা হয়। জগন্নাথপুরে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ব্যায়ে স্থাপন করা হয় দুই হাজার ৫০০ হ্যান্ড টিউবওয়েল ও সাড়ে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার ৮৮০টি টিনশেড ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালে। দুই উপজেলায় পাঁচ হাজার ৮০০ টিউবওয়েল স্থাপন করতে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই বছরের মাথায় অকেজো হয়ে গেছে বেশিরভাগ টিউবওয়েল। যেগুলো সচল আছে, সেগুলোতে ঝিরিঝিরিয়ে ওঠে পানি।
সরেজমিনে সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের শান্তিগঞ্জের নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় একটি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল মন্ত্রীর বাড়ি ‘হিজল-করচ’ এর সামনে। টিউবওয়েলটি স্থাপন করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬২ হাজার টাকা। এই টিউবওয়েলটিতে উঠছে না পানি। নষ্ট হয়ে পাশে থাকা ওয়াশব্লকের ট্যাপকল পর্যন্ত তুলে নেয়া হয়েছে।
এলাকার তরুণ বরুণ দাস বলেন, শুধু এই টিউবওয়েলেই নয়, গ্রামে আরও যেসব টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছিল, সব টিউবওয়েলেরই একই অবস্থা। পাম্পগুলোও চুরে নিয়ে গেছে। শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের শিমুলবাক গ্রামে আরও করুণ অবস্থা। এই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সরকারি টিউবওয়েল। কিন্তু দুই একটা বাদে সবগুলোই নষ্ট। কোনোটার হ্যান্ড টিউবওয়েল বা পাম্প আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। সরকারি ৭ হাজার টাকা ফি’ দিয়ে টিউবওয়েল পেলেও মাত্র কয়েকমাস পানি খাওয়ার পর বার বার নষ্ট হওয়ায় উল্টো বিপাকে পড়েছেন সাধারণেরা।
শিমুলবাক গ্রামের তাহির মিয়া একটি সচল টিউবওয়েল দেখিয়ে বললেন, গ্রামের এই কান্দার মধ্যে একটা, আর আগলা বাড়িতে একটা টিউবওয়েল আছে, বাকি সব নষ্ট। পানি খেতে হয় আগলা বাড়ি থেকে এনে।
গ্রামের নূর উদ্দিন বললেন, আমরা টাকা দিলাম। যারা বসালো তাদেরও কয়েকদিন খাওয়ালাম। কিন্তু কোন কাজে আসেনি, পানি খেতে পারলাম না। কেবল বাড়ির জায়গা দখল করে আছে হ্যান্ড টিউবওয়েলটি। আমরা দূর দূরান্ত থেকেই পানি আনতে হয়।
এই গ্রামের মধ্য বয়সী এক নারী বললেন, ছয় মাসও পানি খেতে পারলাম না। এখন বাড়ির সামনে টিউবওয়েল আছে, কিন্তু পানি নাই, আমাদের কষ্ট আর ভোগান্তি রয়েই গেল।
এমন পরিস্থিতিতে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় হ্যান্ড টিউবওয়েল না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানালেন, উপজেলা জনস্বাস্থের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আতিউর রহমান। তিনি বললেন, এসব এলাকায় শুকনো মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, তাই এখানে হ্যান্ড টিউবওয়েল বসানোর উপযুক্ত নয়।
শুকনো মৌসুমে পানি উঠে না জেনেও সেখানে এমন টিউবওয়েল কেন স্থাপনা করা হলো। একজন প্রকৌশলী হিসেবে আপনি কি বলবেন. এমন প্রশ্ন ছিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সুনামগঞ্জের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ খালেদুল ইসলামের কাছে। জবাবে তিনি বললেন, স্থানের প্রেক্ষাপটে এমন প্রকল্প গ্রহণ অপরিকল্পিত। আমি কাজ করলে, এখানে সাবমারসিবল টিউবওয়েল স্থাপন করবো। আগে টিউবওয়েল সংখ্যা বাড়াতে, বা বেশি মানুষের বাড়িতে টিউবওয়েল দিতে হয়তোবা এমন কাজ করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সুনামগঞ্জের সভাপতি আইনজীবী নাজমা বেগম বললেন, অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে লুটপাটের প্রাথমিক স্টেজ। যারা এই কাজ করেছে, তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। এর মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। জনগণের কোটি কোটি টাকা যারা অপচয় করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।