রাজধানীতে গত ৫ আগস্টের সকাল ছিল একদম থমথমে। প্রধান সড়কে মানুষ ও যানবাহন চলাচল তেমন ছিল না। তবে মাঝেমধ্যে কিছু জায়গায় সরকার পতনের দাবিতে মিছিল দেখা যায়। সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার পর ধীরে ধীরে বাড়ে মানুষের উপস্থিতি। সেই সঙ্গে বড় হতে থাকে মিছিল। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে তখনও মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছে পুলিশ। এর মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা ছিল যাত্রাবাড়ীতে। দুপুরের পর শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে বিজয় মিছিল শুরু হয়। মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খুব কাছ থেকে খোকন চন্দ্র বর্মণকে (২৩) গুলি করে পুলিশ। তাঁর নাক-মুখ উড়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সড়কে পড়ে থাকার কিছুক্ষণ পর কয়েকজন উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে নেন।
বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন খোকন। সেখানে চিকিৎসকদের চেষ্টায় তাঁর মুখের ক্ষতস্থান কিছুটা সেরে উঠলেও যন্ত্রণা কমেনি। খোকনের নাক নেই; শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে নলের সাহায্যে। ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। আরেক চোখে কোনো রকমে দেখতে পান। ঠোঁটের ওপরের অংশ নেই। কথা বললে স্পষ্ট বোঝা যায় না। শক্ত কোনো খাবার খেতে পারেন না। এ অবস্থায় দ্রুত উন্নত চিকিৎসা জরুরি। কিন্তু সেটা মিলছে না।
খোকন বলেন, ‘এত জ্বালা-যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। ডাক্তারকে বলছি, হয় আমাকে দ্রুত চিকিৎসা দেন, না হয় মেরে ফেলেন। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।’
পেশায় প্রাইভেটকারচালক খোকনের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ভুইঘর সোনালী মার্কেট এলাকায় থাকেন। বাবা কৃষ্ণচন্দ্র বর্মণ একটি হাসপাতালে খাবার সরবরাহের কাজ করেন। মা রানী দাস কাজ করেন অন্যের বাড়িতে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটের ৭০১ নম্বর কক্ষের ৮ নম্বর শয্যায় খোকনকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁর এক চোখ ভেতরে দেবে আছে। নাকের জায়গায় নল লাগানো। হঠাৎ তাঁকে দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। কাছে যেতেই আঙুল উঁচিয়ে নিজের মুখমণ্ডল দেখিয়ে খোকন বলেন, ‘এটা আমার জন্য মরণ-যন্ত্রণা। ওই দিন (৫ আগস্ট) বিকেলে মিছিলে পাখির মতো গুলি ছোড়ে পুলিশ। এক পুলিশ সদস্য আমাকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আমি রাস্তায় পড়ে যাই। চিৎকার করে সহযোগিতা চাইতে থাকি। এর কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে।’
খোকনের পাশের শয্যায় আহত আরেক আন্দোলনকারী তাঁর মোবাইল ফোনে সেই দিনের একটি ভিডিও দেখান। এতে দেখা যায়, সড়কে পড়ে আছেন রক্তাক্ত খোকন। তাঁর এই অবস্থা দেখে কয়েকজন কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘আল্লাহ তুমি দেহ, আল্লাগো … তুমি বিচার করো।’ এর পর একজনের সহায়তায় খোকন উঠে হাঁটতে থাকেন।
খোকনের অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। দেশের বাইরে নিয়ে মুখ পুনর্গঠনে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ৪ থেকে ৮ কোটি টাকা। সরকারের পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে সাজেদা ফাউন্ডেশন। তবে খোকনকে কবে বিদেশে নেওয়া হবে বলতে পারছে না কেউ। ১৭ আগস্ট বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক অধ্যাপক লুৎফর কাদের লেনিনের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। সেই বোর্ডের পরামর্শে তাঁকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে খোকন বলেন, ‘দুই মাস ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। পাসপোর্ট জটিলতার উন্নত চিকিৎসা আটকে ছিল। গত এক সপ্তাহ হলো সেটা প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন বিদেশ নিতে কীসের বাধা?’
খোকনের ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘চিকিৎসায় এরই মধ্যে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মায়ের জমানো ও স্বজনের কাছ থেকে ধার করে এসব টাকা জোগাড় করেছি। এর বাইরে শিক্ষার্থীরা সহযোগিতা করেছেন।’
বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন তরিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, খুব কাছ থেকে খোকনকে গুলি করায় মুখে জটিলভাবে ক্ষত হয়েছে। মুখ পুনর্গঠনে অস্ত্রোপচার করতে হবে, যা বাংলাদেশে হয় না। এর জন্য জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ায় কথা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ধাপে ধাপে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয় এই চিকিৎসায়। কমপক্ষে তিন থেকে ছয় মাস বিদেশে অবস্থান করতে হবে। সরকার যেহেতু চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে, তাই খোকন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকবেন। এখান থেকেই তাঁকে বিদেশে পাঠানো হবে।
এদিকে খোকনের চিকিৎসার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য সচিব তারেকুল ইসলাম সোমবার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘খোকন ভাইয়ের মুখের মাত্র ৭ ইঞ্চি দূর থেকে শটগান ফায়ার করে পুলিশ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। … অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া থেকে পজিটিভ রেসপন্স পেয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমে ৮ কোটি টাকা এবং পরে কমিয়ে ৪ কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানানো হয়। এদিকে রাশিয়ায় আরও অনেক কম খরচে পাঠানো যাবে (৪০ লাখ রুবল)। আশা করি, খুব দ্রুতই খোকন ভাইয়ের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবো।’
সিলেট ক্রাইম রিপোর্ট/এস.এ