
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর শেখ মুজিবুর রহামানের বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তিন তলা বাড়িটির ক্ষুদ্র একটি অংশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটির আশপাশে থাকা বাকি স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িটির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন ধ্বংসস্তুপ। এক্সক্যাভেটর ও ক্রেন নিয়ে ভেঙে ফেলা হয় বাড়িটি। এছাড়া ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এসব দেখতে ভীর জামাচ্ছেন উৎসুক জনতা। ভবনের ভেতর থেকে স্টিল, লোহা, টিন, কাঠসহ বিভিন্ন জিনিস ভেঙে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এদিকে আয়না ঘর মনে করে শেখ মুজিবুরের বাড়ির উত্তর পাশে নির্মাণাধিন ভবনের ২ তলা ব্যাজমেন্ট ঘিরে আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাছাড়া নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় নিচের তলায় ছিল হাটু সমান পানি। এই দৃশ্য দেখতে জড়ো হয় সাধারণ মানুষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৩২ নম্বর বাড়ির ডান পাশের ভবনের এক তৃতীয়াংশ ভাঙা হয়েছে। বাড়িটির ভবনগুলো এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে, যেকোনো সময় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। আর ধ্বংস স্তুপগুলো পড়ে আছে চারপাশে। এসবের উপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এসব দেখতে সব বয়সের মানুষের ভীর লক্ষ করা গেছে। পুরো এলাকা জুড়ে হাতুড়ির আঘাতে নানা কিছু ভাঙার শব্দ শোনা যায়। নিম্ন আয়ের মানুষ ও পথশিশুরা বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ থেকে টিন, লোহা-রড, বই নিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত থেকেই এ লুটপাট চলছে, যা সকাল থেকে আরও বেড়েছে। ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য দেখা যায়নি। জাদুঘরের পেছনের উত্তর দিকের ছয়তলা ভবনটিও ভাঙা হয়ে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এই পরিস্থিতি চলার মধ্যেই ধানমন্ডি ৫ এ শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দেওয়া হয়। রাত পৌনে ১১টার দিকে কয়েকজন তরুণ এসে তালাবন্ধ সুধাসদনে আগুন লাগিয়ে দেয়। ৫ অগাস্ট সুধাসদনে এক দফা হামলা হয়। এরপর সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তালা মেরে যায়। বুধবার রাতে সেই তালা ভেঙে আগুন লাগানো হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বললেও নেভাতে আসেনি ফায়ার সার্ভিস। সেখানে আগে থেকেই রাখা আসবাবপত্রে আগুন লেগে গেলে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় আশপাশের নিরাপত্তাকর্মীরা এসে পানির পাইপ দিয়ে নিচতলার আগুন নেভায়। শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাক নাম ছিল সুধা মিয়া। তার নামেই এ বাড়ির নামকরণ
সুধা সদনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দোতলায় আগুন জ্বলছে। ভবনের নিচতলা থেকে চারতলার বিভিন্ন কক্ষে আগুন ও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা যায়। কোথাও কোথাও টাইলস খুলে ফেলা হয়েছে। পোড়া গন্ধ চারদিকে। বাড়িটির সামনে উৎসুক কয়েকশ মানুষের ভিড় দেখা যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেসব অক্ষত জিনিসপত্র আছে, সেগুলো নিয়ে যায়।
বিক্ষুব্ধ জনতা জানায়, শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারের কোনো চিহ্ন এই জাতি দেখতে চায় না। জুলাই গণহত্যা নিয়ে আমাদের মাঝে এখনো ক্ষত রয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলেছেন। তাঁর এই সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। যারা দেশ, জাতি ও ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করেন, তাদের পরিণতি কী, এই বাড়িটি দেখেই সবাই বুঝতে পারবে। এ থেকে সবাই শিক্ষা নেবে, ভবিষ্যতে দেশ এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে তার পরিণতি এমনই হবে।
বিক্ষুদ্ধ এক শিক্ষার্থী জানায়, শেখ মুজিবুরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত যাবে না বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনাকে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এটি ভাঙার মাধ্যমে আমরা সবাইকে ফ্যাসিবাদের পরিণতি উপলব্ধি করাতে পারব। এই বিপ্লব যাতে বিঘ্নিত না হয়, যারা শহীদ হয়েছে, তাদের রক্ত যাতে বৃথা না হয়। সেজন্য এই বাড়িটি ভাঙা জরুরি। এখানে স্বৈরাচারের চিহ্ন মুছে দিয়ে কোনো চিহ্ন রাখা যাবে না বলেও জানান তিনি।
এদিকে গত বুধবার রাত ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তৃতা প্রচার করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বুধবার দিনভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা চলে। বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি। সন্ধ্যা সাতটার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, গত বুধবার রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমিমুক্ত হবে।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জড়ো হতে থাকেন। রাত আটটার দিকে বিক্ষোভকারীরা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন। এসময় বাড়ির সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও ভাঙচুর করা হয়। তারপর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ভবনের তৃতীয় তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে রাত ৯টার দিকে লাঠিসোঁটা ও শাবল দিয়ে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভাঙা শুরু হয়। সেনাবাহিনীর একটি দল ৩২ নম্বর আসলেও তাদের উপেক্ষা করে মধ্যরাতে বুলডোজার দিয়ে ভবন ভাঙা শুরু হয়। রাত দুইটা নাগাদ বাড়িটির বড় অংশ ভাঙা শেষ হয়। রাতভর ভবন ভাঙার কাজ চলে। বৃহস্পতিবার ভোরে আবারও শুরু হয় ভবন ভাঙার কাজ চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। ততক্ষণে বাড়িটির অনেক অংশই গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিলেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পর থেকে বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
এস.এ…